কালজয়ী কবি আল্লামা শেখ সাদি (রঃ)


আল্লামা শেখ সাদি (রঃ), প্রায় ৮৫০ বছর আগে জন্ম নেয়া এক সার্থক কবি। খোদা ভিরু,আল্লাহ ওয়ালা, ধার্মিকতায় পরিপূর্ণ ছিল যার জীবন। আধ্যাত্মিকতায় ও ছিল অবাধ বিচরণ। ধর্মীয় জ্ঞান ছিল যেমন প্রখর, তেমনি বাস্তবিক জ্ঞানও ছিল অসাধারন। বর্তমান সময়ে অনেকেয় তার লেখা কবিতা, বিভিন্ন ঘটনা যা তার জীবদ্দশায় ঘটেছিল তাই নিয়ে গবেষণা করছে। মাদ্রাসার পাঠ্য পুস্তকে তার লেখা বইও স্থান পেয়েছে। গুলিস্তা ও বোস্তা তার বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থ দুটিতে তিনি নৈতিকতার বিষয়ে অনেক উপদেশমূলক ঘটনা তুলে ধরেছেন। আদ্ধাতিকতার পরশ মিশ্রিত এই বই দুটিতে আল্লাহ প্রেমের উপজিব্য বিষয় খুজে পাওয়া যায়।
তার প্রকৃত নাম নিয়ে কিছু মতানৈক্য থাকলেও তার আসল নাম মুসলেম উদ্দিন। সবথেকে বেশি যেই উপাথিতে তিনি ভূষিত হয়েছেন সেটি হল সাদি। তাই তিনি শেখ সাদি নামেই বেশি পরিচিত। তার জীবনে তিনি অসংখ্য দেশ ভ্রমন করছেন। ভ্রমন করতে করতে তিনি বাস্তবিক জীবন থেকে অনেক কিছুর অভিজ্ঞতা নিয়েছেন। এই অভিজ্ঞতা গুলো তিনি তার লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
৫৮০ হিজরি মোতাবেক তিনি ইরানের সিরাজ নামক শহরে জন্ম গ্রহন করেন এবং ৬৮২ হিজরিতে তিনি সিরাজ শহরেই মৃত্যু বরন করেন। শেখ সাদি রঃ এর জীবনের শেষ সময়টাকে অনেকে আধ্যাত্মিক সাধনার সময় হিসাবে তুলে ধরলেও তিনি মুলত ছোট কাল থেকেই আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোনিবেশ করেন। আজকে এই লিখনির মাধ্যমে তার লেখা কিছু উপদেশ ও কিছু কাহিনি তুলে ধরার চেষ্টা করব। যদি কোন ভুল কেউ খুজে পান তাহলে আমাকে জানালে উপকৃত হব।

নিম্নে কিছু কবিতার লাইন তুলে ধরা হল।
১/ অল্পতে তুষ্ট থাকাঃ
" খোদারা নাদানাস্ত ও তায়াত না করদ,
কে বরবখতে রুজি কানায়াত না করদ
কানায়াত তাওয়াঙ্গার কুনাদ মরদেরা
খবর কুন হারিছে জাহা গেরদেরা"

অর্থঃ কবি বলেন যে বেক্তি আল্লাহার দেয়া রুজির উপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেনা, সে আল্লাহকে চিনেনা, এবং তার ইবাদাত বন্দিগি করেনা। অল্পতে সন্তুষ্টি করলে আল্লাহ তাঁকে আমির বানিয়ে দেয়। তুমি তালাশ করে দেখ,যারা লোভে পরে দুনিয়া ঘুরে বেড়ায় তারা কখনোই শান্তি লাভ করতে পারেনা। 

২/ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা 
"নাফাছ মি নাইয়ারাম জাদাজ শোকরে দাস্ত,
কে শোকরে নাদানাম কেদর খোরদে উস্ত।
আতাইস্ত হর মুয়ে আজুবর তনাম,
চেগুনাবহর মুয়ে শোকরে কুনাম।"

অর্থঃ কবি আল্লামা শেখ সাদি (রহঃ) আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্পর্কে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে বলেছেন আমি আমার বন্ধুর শুকরিয়া আদায় করার জন্য একটি শ্বাসও টানতে পারিনা। কেননা, তাঁর কৃতজ্ঞতা কি দিয়ে জ্ঞাপন করব, তাই আমার জানা নেই আমার শরীরের প্রতিটি পশমই তাঁর দান। তাই চিন্তা করতে পারিনা যে, প্রতিটি পশমের বদলে কিভাবে শোকর আদায় করবো।

৩/ যৌবনকাল লুটের মাল
"জওয়ানা রাহে তাআত ইমরোজ গির,
কেফরদা জাওয়ানি নাইয়ায়েদ যে পীর।
ফারাগে দেলাত হাস্ত নিরুয়ে তন,
চু ময়দান ফরা খাসতেগুয়ে বজন।"

অর্থঃ কবি আল্লামা শেখ সাদি (রহঃ) বলেছেন, হে যুবক! এখন ইবাদতের পথ ধর। কেননা বৃদ্ধকাল এসে গেলে যৌবনকাল আর ফিরে পাবেনা, তোমার এখন নিশ্চিন্ত হৃদয় এবং শরীরে শক্তি আছে। যখন ময়দান খালি আছে, তখন বল ছুড়ে মার। অর্থাৎ এখন সুযোগ আছে, কাজ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাও। 

৪/ মানুষের সেবা 
"আলা গর তলব গারে আহলে দেলে,
জে খেদমত মকুন এক জর্মানে গাফেলে।
খোরাশ দেহ বদর রাজে ও কাবক ও হারাম,
কে এক রোজাত উফতাদ হুমায়ে বদাম।"

অর্থঃ কবি আল্লামা শেখ সাদি (রহঃ) বলেছেন, হে পাঠক ! যদি উন্নত মানুষ হতে চাও, তাহলে মহত্তের সেবা কর। এক মুহূর্তও মানব সেবা থেকে ভুলে থেকো না। তুমি সকল প্রকার পাখীর খাদ্য প্রদান কর, তাহলে একদিন তোমার ফাঁদে হুমা পাখী এসে বন্দী হবে, যার বদৌলতে তুমি ভাগ্যবান হতে পারবে। 

কথিত আছে, যে ব্যক্তি জীবনের মায়া ত্যাগ করে, সে ব্যক্তি যা কিছু তার মনে থাকে তা প্রকাশ করতে থাকে।
"ওয়াক্ত জরুরাত চু নামানাদ গুরেজ
দস্তে বগিরাদ ছারে শামশিরে তেজ"
অর্থঃ অসহায় অবস্থায় যখন পালিয়ে যাবার পথ না পায়, তখন ধারাল তরবারির অগ্রভাগও হাত দিয়ে ধরতে সে দ্বিধা বোধ করে না। 

ইরানের বাদশাহ নওশিরওয়ান হরমুজের নছিহত 
"শনিদাম কে দর ওয়াক্তে নেজায়া রওয়া,
বহরমুজ চুনি গোপত নওশিরওয়া।
কে খাতের নেগাহদার দরবেশ বাশ,
না দরবন্দে তাছায়েশে খেশ বাশ।
নাইয়া ছায়েদ আন্দর দিয়ারে তু কাছ,
চু আছয়েশে খেশ কাহি ও বছ।
নাইয়ায়েদ ব নজদিকে দানা পছন্দ,
শবা খোফতা গোরগদর ও গোছফান্দ।

কবি শেখ সাদি (রহঃ) বলেছেন, নওশিরওয়া তাঁর মৃত্যুর সময় পুত্র হরমুজকে নিম্নরূপে নছিহত করে গেছেন।
অর্থঃ আমি শুনেছি, নওশিরওয়া বলেছেন, তোমার কলব সব সময় গরীব ও দরবেশের দিকে অনুপানিত রেখে কেবল নিজের কল্যাণের জন্য চিন্তা করোনা। তুমি যদি নিজের শান্তি ও আরাম চাও, তাহলে তোমার রাজ্য প্রজাদের কখনো শান্তি ও আরাম হবেনা। কোন জ্ঞানী ব্যক্তি এ কথা পছন্দ করবেনা, রাখাল নিশিতে ঘুমিয়ে থাকবে এবং বকরির পালে চিতাবাঘ ঢুকবে। মুখাপেক্ষী গরীব দরবেশদের প্রতি নজর রাখবে। কেননা, বাদশাহ প্রজাদের কারণেই সম্মানিত এবং রাজত্ব স্থায়ী হয়।

এছারাও অসংখ্য শের বা কবিতার লাইন লিখে গেছেন তিনি, যা মানব জাতির উন্নয়নের পাথেয় হিসাবে কাজে লাগবে। তাঁর উপদেশগুলো প্রতিটা মানুষের নাজাতের মাধ্যম হিসাবে কাজ করবে। নিম্নে  কয়েকটি ঘটনা তাঁর সময়ে ঘটে যাওয়া, তা তুলে ধরা হল।

দরবেশ ও খেক শিয়ালের ঘটনাঃ 

একদিন এক ব্যক্তি একটি বুনো বিড়ালকে তার হাত-পা কাটা অবস্থায় দেখল। তা দেখে সে আশ্চর্য হয়ে গেল, এটা কেমন করে বাঁচে? কিভাবে নিজের আহার সংগ্রহ করে? এটা ভেবে সে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে ধ্যানে মগ্ন হল। কত সময় পর সে দেখল, একটি বাঘ একটি খেঁকশিয়াল শিকার করে নিয়ে আসছে এবং ঐখানে বসে সে খেঁকশিয়ালটি ভক্ষণ করল। বাদবাকি যা ছিল, ঐখানে ফেলে চলে গেল। বুনো বিড়ালটি যা বাকি ছিল, তা খেয়ে উদরপূর্তি করে নিল। এটা দেখে লোকটি সেখান থেকে ঐ দিনের জন্য চলে গেল। পরের দিন আবার তাকে দেখার জন্য লোকটি সেখানে গেল। গিয়ে দেখল- পূর্বদিনের মত আজও বাঘটি একটি শিকার এনে ঐ স্থানে বসে খেয়ে গেল। এটা দেখে লোকটির দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, রিজিকদাতা জাকে ইচ্ছে করেন রুজি পৌঁছে দেন। রুজি নিজের ইচ্ছের উপর অর্জন করা যায়না। একথা ভেবে সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে গেল এবং মনে মনে স্থির করল যে, পিঁপড়ের মত এককোণে গিয়ে বসে থাকব। হাতীও নিজের শক্তিতে রুজি সংগ্রহ করতে পারেনা। কয়েকদিন একাকী বসে মহান আল্লাহর দিকে চেয়ে রইল যে, তিনি রিজিক পাঠিয়ে দিবেন। তার জন্য কোন ব্যক্তি চিন্তা করল না অর্থাৎ নিজের আত্মীয়-স্বজন বা অপরে কেউই  তাকে খাদ্য দিল না এবং কেউ তার জন্য ভাবলও না।
অবশেষে না খেয়ে শুকিয়ে সে ব্যক্তি কাঠ হয়ে গেল। আর সহ্য করতে না পেরে বেহুস হয়ে পড়ে রইল, তখন সে মেহরাবের দেয়াল থেকে আওয়াজ শুনতে পেল, হে ছোটলোক কমবখত! উঠ, যাও এবং হিংস্র বাঘের মত হও, নিজের হাত পা-কাটা বন বিড়ালের মত বানিয়ো না। এরকম ভাবে চেষ্টা কর, যেন বাঘের মত কামাই করে অপরকেও খাওয়াতে পার। বন বিড়ালের মত অবশিষ্ট খেয়ে কেন জীবন ধারণ করবে ? যার গরদান বাঘের মত মোটা, সে যদি বন বিড়ালের মত পড়ে থাকে, তাহলে সে কুকুরের  চেয়েও অধম। নিজের হাতের জোরে উপার্জন কর, অন্যকে খাওয়াও। অন্যের উপর নির্ভর করো না। মানুষের মত কষ্ট সহ্য কর, অন্যকে শান্তি দাও। পুরুষের অর্জন নপুংশকে খায়। অপরকে সাহায্য কর। অপরের সাহায্যর জন্য চেয়ে থেকো না। ঐ ব্যক্তির উপর আল্লাহর মেহেরবানী থাকে, যে ব্যক্তি অন্যকে শান্তিতে রাখে। দুনিয়া আখেরাত ঐ ব্যক্তির জন্য ভাল হয়, সে সৃষ্টজীবকে শান্তি দেয়। 

আল্লামা শেখ সাদি (রঃ) এর জীবনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনাই মানব জাতির জন্য একেকটি শিক্ষা। তার কবিতা,উপদেশ ও আধ্যাত্মিকতার নানা ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ও সমাজের অবস্থান পরিবর্তন করে দিতে পারি। তার লেখনি থেকে সবাই যাতে কল্যাণকর হতে পারে তার জন্যই নতুন করে পাঠকের সামনে তুলে ধরার সামান্য চেষ্টা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করুক।