মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তরায়


মানুষ সামাজিক জীব, সৃষ্টিকুলের ভিতরে মানুষই একমাত্র প্রাণী, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন, যার কারণে কেয়ামতে বিচারও হবে মানুষের অন্য কোন প্রাণীর বিচার ও হবেনা, তাই জ্ঞান অর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করে মানুষ আজ অনেক উন্নত আবার অন্য দিকে মানুষ জ্ঞানের সঠিক ব্যাবহার করতে না পেড়ে মানুষ হয়েও অমানুষের মত জীবন যাপন করছে। শিক্ষা বিহীন একটি সুস্থ সমাজ চিন্তা করা অকল্পনীয়, শুধু শিক্ষা গ্রহণ করলেই হবেনা, পাশাপাশি সুশিক্ষা অর্জন করাও জরুরী। এমতবস্থায় শিক্ষার প্রসার ঘটানো সকল নাগরিকের দায়িত্ব। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই লেখা।
বাংলাদেশে কয়েক ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা নিরক্ষর থেকে সাক্ষরতা শিখতে পারি, একটি জাতি গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম, শিক্ষা বিনা জাতি গঠন করা প্রায় অসম্ভব। যেই সমস্ত জায়গা গুলোতে শিক্ষার বিস্তার সব থেকে বেশি ঘতেছে তারাই আজ সবথেকে সমৃদ্ধিশালি হয়েছে।
নবী রাসূল থেকে শুরু বিভিন্ন ধর্মের পথ প্রদর্শকগন স্রষ্টার দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি জ্ঞানার্জনের দাওয়াত ও দিয়েছেন বেশি। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রথম শিক্ষার বাণীই দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের প্রথম বানীই হলো, “পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন” এ থেকেই বুঝা যায় জীবন ও সমাজ গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
বিখ্যাত দার্শনিক এরিষ্টটল বলেন “শিক্ষার শেকরের স্বাদ তেতো হলেও এর ফল মিষ্টি” আরেক দার্শনিক নিকোলাস খলব্রাঁশ বলেছেন “দেখবার জন্য আমাদের চোখের যেমন আলোর প্রয়োজন ঠিক তেমনি কোন প্রত্যয় অর্জনের জন্য আমাদের ভাবনার প্রয়োজন” এরিষ্টটল আরো বলেছেন “যে কখনো ভুল করেনা সে নতুন কিছু করার ও চেষ্টা করেনা”
কালজয়ী কবি আল্লামা শেখ সাদি (রাঃ) জ্ঞান বিষয়ক বাণীতে বলেছেন “একজন ঘুমন্ত ব্যাক্তি আরেকজন ঘুমন্ত ব্যাক্তিকে জাগ্রত করতে পারেনা” তিনি আরো বলেছেন “অজ্ঞের পক্ষে নিরবতাই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম পন্থা যদি সবাই জানত তাহলে কেই অজ্ঞ থাকতনা”
আরেক দার্শনিক শেলি বলেছেন “আমরা যতই অধ্যায়ন করি ততই আমাদের অজ্ঞতাতে আবিস্কার করি” এতো শুনলাম দুনিয়ায় বিখ্যাত হওয়া দার্শনিকদের কথা।
এবার আসি যুগশ্রেষ্ট দার্শনিক ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে যিনি শ্রেষ্ট দার্শনিক ও আদর্শ শিক্ষক হিসাবে ভূষিত হয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কি বলেছেন এই শিক্ষা অর্জন নিয়ে।
حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ عُفَيْرٍ، قَالَ حَدَّثَنَا ابْنُ وَهْبٍ، عَنْ يُونُسَ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، قَالَ قَالَ حُمَيْدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ سَمِعْتُ مُعَاوِيَةَ، خَطِيبًا يَقُولُ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ "‏ مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ، وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَاللَّهُ يُعْطِي، وَلَنْ تَزَالَ هَذِهِ الأُمَّةُ قَائِمَةً عَلَى أَمْرِ اللَّهِ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ
হুমায়দ ইব্‌নু ‘আবদুর রহমান (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেনঃ আমি মু’আবিয়াহ (রাঃ)-কে খুৎবায় বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দ্বীনের ‘ইল্‌ম দান করেন। আমি তো বিতরণকারী মাত্র, আল্লাহই (জ্ঞান) দাতা। সর্বদাই এ উম্মাত ক্বিয়ামাত পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমের উপর কায়েম থাকবে, বিরোধিতাকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (বুখারি-৭১)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ (الزمر: ٩)
অর্থঃ “যারা জানে এবং যারা জানেনা তারা কি সমান হতে পারে?” (সুরা যুমার-৯)
উপরের আয়াত ও হাদীসের বাণী এগুলোর দ্বারা বুঝা যায় যে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত বা মনুষত্ব গ্রহণ করার জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই।
আলোচ্য বিষয় হলে মাদ্রাসা শিক্ষার অন্তরালে বাংলাদেশ আয়তনের দিক দিয়ে খুব বড় একটি দেশ না হলেও বর্তমানে এর উন্নয়ন ও স্বাক্ষরতার হরের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে, বাংলাদেশে স্বাক্ষরতার হার প্রায় ৫৮% উইকিপিডিয়া অনুযায়ী। যেখানে আন্তরা নামক একটি রাষ্টের স্বাক্ষরতার হার ১০০% উইকিপিডিয়ায় এমনটায় উল্লেখ করা আছে। আমাদের দেশে স্বাক্ষরতার হার প্রতি বছরেই বেড়ে চলছে, এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও অনেক।


আমাদের দেশে কয়েক ধরণের শিক্ষা ব্যাবস্থা চালু আছে, সবাই সবার সুবিধামত শিক্ষা নিতে পারে, শিক্ষা ব্যাবস্থাগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলে.
১। সাধারণ শিক্ষা (বাংলা ও ইংরেজি)
২। কারিগরী শিক্ষা
৩। মাদ্রাসা শিক্ষা
         * কওমী সিলেবাস
         * আলিয়া সিলেবাস
সকল ব্যবস্থায় সমানভাবে সমাজকে সাহায্য করে যাচ্ছে, এবার আসা যাক মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যাবস্থার কয়েকটি বিষয় নিয়ে।
মাদ্রাসা শব্দটি আরবি শব্দ এটি মূলত ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার একটি বিদ্যালয়, কোরআন, হাদিস, ইসলমি আইন, ইসলামি ফিকাহ শরিয়া এই সমস্ত বিষয়গুলো শিক্ষাদানের একটি পাঠশালা।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উৎস হলো,
১। কোরআন, ২। হাদিস, এই দুই বিষয়কে লক্ষ রেখে দুনিয়া ও আখেরাতের শিক্ষা দেয়া হয়, মাদ্রাসা শিক্ষা দুই ধরণের হওয়ায় এর সিলেবাস ও আলাদা।
কওমি ধরণের মাদ্রাসায় ধর্মীয় বই পুস্তক বেশি এবং এটি আরবী কারিকুলামে পাঠ দান করা হয়, তবে বর্তমানে সরকারি অনুমোদন দেওয়ায় আরবী শিক্ষার পাশাপাশি কিছুটা বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে এটা যে খুব বেশি শিখানোর হয় তা নয়। তবে বর্তমান সরকার এই কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি মানদন্ডে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেছে, পূর্বে এই শিক্ষা ব্যবস্থার কোন সরকারিভাবে কোন মূল্যায়ন ছিলনা, ইতিমধ্যে সরকার কওমী শিক্ষার দাওরা শ্রেণীকে মাষ্টার্স এর সমমানে মর্যদা দিয়েছে। এতে করে এই শিক্ষা ব্যবস্থা একটি সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে, বাস্তবিক অর্থে কওমী শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী জ্ঞানের সঠিক স্বাদ পাওয়া যায়, কওমি সনদ নিয়ে অনেক মতানৈক্য থাকতেই পারে, আমি সেই বিষয়ে আলোচনায় নাইবা গেলাম।
এবার আসা যাক আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা, সম্পর্কে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষাটা হলো মুলত সাধারণ ও আরবী শিক্ষা ব্যবস্থার একটি যৌথ শিক্ষা।
এখানে বাংলা, ইংরেজি বিজ্ঞান ও অনান্ন সাবজেক্ট এর পাশাপাশি সমানভাবে আরবী সাবজেক্ট গুলোও শেখানো হয়। এই ধারার শিক্ষাটা বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মত একটি ক্ষেত্র। এখানে যেমন, স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটি পড়ুয়া একজন ছাত্র যে জ্ঞান অর্জন করে সেখানে একজন মাদ্রাসা ছাত্র সেই জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষায় ও সমান তালে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে আজ যা কিছু অর্জন, তার অনেকটাই কোরআন হাদিস থেকে নেয়া, মহাকাশ বিজ্ঞান চিকিৎসা বিজ্ঞান এর অনেক নিদর্শনই কোরআনে অনেক আগেই দেয়া হয়েছে। প্রাচিন যুগের অনেক ঘটনাও এই কোরআনে উল্লেখ আছে, এই কারণে মাদ্রাসায় যারা পড়াশুনা করে তারা অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকে।


সমিক্ষায় দেখা গেছে গত কয়েক বছর ধরে মাদ্রাসার ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ প্রকৌশলি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তির হার অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে, এবং এই হার দিনদিন বেড়েই চলছে, চলতি বছরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসার ছাত্ররা তাদের মেধার পরিচয় তুলে ধরেছে। রাসুল (সাঃ) এর একটি হাদিস আছে যেখানে তিনি বলেছেন, আলেমরা হলে নবীগনের উত্তরসুরী (আল হাদীস)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন।
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ
অর্থঃ নিশ্চয়ই তাঁর বান্দাদের আলেমগণই আল্লাহকে সত্যিকার অর্থে ভয় করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিশালি ও ক্ষমাশীল। [আল-ফাতির: ২৮]
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তরালে মুল যে বিষয়টি আছে, সেটি হলো খোদাভীতি অর্জন করার পাশাপাশি দুনিয়াবি জ্ঞান অর্জন করার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি অর্জন করা। তাই প্রতিটা মুসলমানের উচিৎ তাদের সন্তানদের সামান্ন হলেও মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করা।