রবিউল আওয়াল মাসের তাৎপর্য ও শিক্ষা

১২ই রবিউল আওয়াল, এই দিনটির কথা শুনলে বা মনে আসলে, মনের কোনে দুই ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। কখনো আনন্দ কখনো বেদনা। এই দিনটি মুসলিম জাতি তথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসাবে পালিত হয়। পৃথিবী সৃষ্টির সাথেও এই দিনটি সরাসরি জরিত।
এই দিনে এমন একজন মানুষের পৃথিবীতে আগমন হয়, যাকে সৃষ্টি না করলে এই জগত সৃষ্টি হতনা।
সৃষ্টি হতনা মানব ইতিহাস। সৃষ্টি হতনা মহা বিশ্বের সবথেকে নির্ভুল ও বিশ্বাসযোগ্য গ্রন্থ, মহাগ্রন্থ আল কোরআন। তিনি আর কেউনা তিনি হলেন আমার আপনার সকলের প্রিয় নবি, আখেরি জামানার শেষ নবী, নবীদের সর্দার,পরকালে মানুষের নাজাতের ফয়সালাকারী, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)।
এইদিনে তিনি যেভাবে জন্মগ্রহন করেন, আবার এইদিনেই তিনি মৃত্যুবরন করেন। এটিও একটি বিশ্বয়কর ঘটনা। যার কারণে বর্তমানে সাড়া বিশ্বে এইদিনটি দুইভাবে পালিত হচ্ছে। কেউ কেউ জন্মদিবস পালন করছে, আবার কেউ মৃত্যুদিবস পালন করছে। এতে করে সমাজে একটা বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে, সবাই সবার কাজকে সঠিক হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিপক্ষে সাফাই গাচ্ছে। যা কিনা রাসুলের (সঃ) আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।

কে এই মুহাম্মাদ? কি তার পরিচয়? কেনইবা তাকে আল্লাহ এই দুনিয়াই পাঠিয়েছেন? সবার আগে তাকে সৃষ্টি করে কেন তাকে সব শেষে এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন? এই বিষয়গুলো যখন আমাদের সামনে স্পষ্ট হবে তখন আমরা আরও ভালো করে তাকে চিনতে পারব।
 একদিকে তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসুল। অন্যদিকে তিনি একজন পৃথিবীর মানুষ-রক্তে মাংসে গড়া তার শরীর। একদিকে তিনি স্রষ্টার অন্যদিকে তিনি সৃষ্টির। এই দুইয়ের সমন্নয়ে আমরা যদি তাকে চিনতে চাই, তাহলে আমাদের জ্ঞান চক্ষুকে আরও অনেক গভীরে নিয়ে যেতে হবে। স্বাভাবিক জ্ঞানে তাকে চিন্তা করা অনেক কঠিন একটি কাজ হবে আমাদের জন্য। তিনি কি মানুষ, নাকি তিনি অতি মানুষ? এই বিষয়গুলোও আমাদের ভালভাবে চিন্তা করতে হবে। আমরা যদি তাকে সাধারন মানুষ হিসাবে চিন্তা করি সেটাও একটি বড় ধরনের ভুল, আবার যদি তাকে অতিমানব হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করি সেটিও একটি বড় মাপের অপরাধ।
তাকে ভালভাবে চিনবার জন্য আমাদের সামনে একটি বিষয় বড় বাধা হয়ে দাড়িয়ে আছে, যেটি হল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমারা আমাদের রাসুলকে ভালভাবে চিনতে পারিনা।
পবিত্র কোরআনেও আমরা অনেক পরিচয় পাই আল্লাহর পক্ষ থেকে। যেমন আল্লাহ বলেন, পবিত্র কোরআনের সুরা কাহাফের ১১১ নং আয়াতে। '' হে মুহাম্মাদ বলে দাও, আমিতো তোমাদের মতো একজন মানুষ মাত্র। তবে পার্থক্য, আমার নিকট অহি অবতীর্ণ হয়। ''
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের শেষ নবীর একটা পরিচয় তুলে ধরেছেন। একদিকে তিনি আল্লাহর রাসুল, মানে অতি মানব, আবার অন্যদিকে তিনি একজন রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ।
সুরা আলে  ইমরানের ১৪৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলতেছেন, '' মুহাম্মাদ একজন রাসুল ব্যতীত কিছুই নন। তার পূর্বেও অনেক রাসুল বিগত হয়েছেন''।(আল কোরআন)
পবিত্র কোরআনে আরও অনেক পরিচয় আমরা পাবো রাসুল (সঃ) সম্পর্কে। যার কিছুটা আজকের লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করব।

একজন মানুষের জন্য রাসুল সঃ এর পুরো জীবনটাই একটা শিক্ষা। রাসুল সঃ যেই সময়টাতে এই দুনিয়ায় আগমন করছিলেন, সেই সময়টা কেমন ছিল? সেখান থেকে তার পরশে কিভাবে সেই সময়টা পরিবর্তন হয়েছে? এই বিষয়গুলো কিছুটা জানলেই আমরা তার আগমনের কারণ বুজতে পারব।
রাসুল সঃ এর পুরো জীবনীকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি। ১/ নবুয়তের আগের সময়

                                                                                                          ২/ নবুয়ত পরবর্তী সময়
এই দুই সময়ে আমরা তাকে অনেকভাবে দেখতে পাবো। আমরা দেখতে পাব, মা আমেনার গর্ভে জন্ম নেয়া রাসুল সঃ কিভাবে তার পরিবারকে রহমতময় ও বরকতময় করে তুলেছেন, আমরা দেখতে পাবো শিশু মুহাম্মাদ সঃ কিভাবে ছোটকালে ন্যায়নীতির পরিচয় দিয়েছেন, দেখতে পাবো বালক মুহাম্মাদ সঃ কিভাবে একজন সংঘটক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন, আরও দেখতে পাব তিনি একজন আদর্শ ব্যাবসায়ি হিসাবে সমাজে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। সর্বোপরি আমরা রাসুল সঃ এর পুরো জীবনীতে দেখেতে পাই, তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ বিচারক, আদর্শ সমাজ সেবক, আদর্শ রাষ্ট্রপ্রধান, এছাড়াও তিনি একজন আদর্শ মহামানব। আদর্শ ন্যায় নিতি, সাহসীকতার সাথে স্রষ্টার বানীকে পুরো দুনিয়ায় ছরিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় ছিল যার পুরো জীবন।

রাসুল সঃ শুধুমাত্র মুসলিম জাতির মুক্তির জন্য এই দুনিয়ায় আগমন করেননি। তিনি সারা মানবজাতির কল্যাণের জন্য আগমন করেছেন। তিনি যেই সময়টায় পৃথিবীতে আসেন তখন সাড়া দুনিয়া ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। মানুষে মানুষে হানাহানি, রক্তারক্তি,খুন রাহাজানি, অবাধ যৌনতা, জীবন্ত শিশু মাটিচাপা দেয়ার মত কঠিন কঠিন কাজ সংঘটিত হত। মাদকের ছিল অবাধ ছড়াছড়ি।
পৃথিবীর ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় তখন রচিত হয়েছিল। রাসুল সঃ এর আগমনের কারণ জানাতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এভাবেই পবিত্র কোরআনের সুরা আরাআফের ১৫৮ নং আয়াতে বলেন, ''হে মুহাম্মাদ ঘোষণা করে দাও, ওহে মানবজাতি, আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর রাসুল''
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,''আমি আপনাকে সমস্ত মানুষের জন্য রাসুলরুপে পাঠিয়েছি এবং আল্লাহই সাক্ষি হিসাবে যথেষ্ট ''। (সুরা নিসা ৭৯)

এ থেকে বুজা যায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসুল সঃ কে শুধুমাত্র একজন সাধারন মানুষ হিসাবে প্রেরন করেন নি, তাকে প্রেরন করার পিছনে সৃষ্টিকর্তার অনেক বড় একটি উদ্দেশ্য নিহিত আছে। রাসুল সঃ কে প্রেরনের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নব্যুয়তি তরীকার সমাপ্তি টেনেছেন।

রাসুল সঃ এসেছেন মানবজাতির কল্যাণের জন্য। তিনি এসেছেন, পথহারা মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য। তার মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়েছিল সাড়া জগতবাসী।তার উদারতা ন্যায় পরায়নতা এতটাই প্রখর ছিল যে আরববাসি তাকে আলামিন বা সত্যবাদী বিশ্বাসী নামে ডাকত। তার ন্যায়পরায়নতার কারণে ইহুদি খ্রিস্টানরা তার কাছেই সবথেকে বেশি নিরাপত্তা পেয়েছে।

বর্তমান সমাজে আজকে আমরা যারা নারি স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছি, সেই নারির স্বাধীনতা ১৪০০ বছর আগেই আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সঃ দিয়ে গেছেন।তার সময়ে নারীর মর্যাদা এতটাই ছিল যে, যা কখনো মানুষ চিন্তা করতে পারে নাই। নারীর সম্মান দিতে গিয়ে রাসুল বলেন, ''যে ঘরে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিল সে ঘর একটি জান্নাতের মালিক হল'' অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ''মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত''।
কালজয়ী কবি, আল্লামা শেখ সাদি রঃ তার বানিতে রাসুল সঃ কে নিয়ে লিখেছেন,
                 সম্মানের ওই শীর্ষশিরে বসলেন ওগো মোদের নবী
                 মানবগুণের পূর্ণতায় তিনি হলেন জগত রবি।
                 চরিত্রের মহত্ত্বে, নাইতো আর কেউ মর্তে
                 তাঁর আলোর আলোতে অন্ধকার গেলো দূরে।
                 চলুন সবাই দুরুদ পড়ি, সেই নবীকে স্মরণ করি
                 তাঁর দেখানো পথে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়ি।

১২ই রবিউল আওয়াল, রাসুল সঃ এর জন্ম দিবস আবার উফাত দিবসও। যার কারণে কেউ এই দিনে মিলাদুন্নবি পালন করছে, আবার কেউ সিরাতুন্নবি পালন করছে। যদি আমরা জন্মদিন হিসাবে এইদিন পালন করি তাহলে আমারা দেখব, কতটা নিকৃষ্টময় সময়ে তিনি পৃথিবীতে আভিরভুত হয়েছেন। তিনি না আসলে আমরা হয়ত পথ হারাই রয়ে যেতাম। সিরাতে মুস্তাকিমের পথ আমরা কখনোই পেতাম না। তিনি এসে এই পথহারা জাতিকে উদ্ধার করেছেন। দিয়েছেন কোরআনের মতো একটি নির্ভুল কিতাব। যা থেকে আমরা পাচ্ছি আমাদের পথের দিশা। তাঁর এই আগমনকে লক্ষ করে আমরা সকলেই তাঁর প্রতি বেশি বেশি দুরুদ পরতে পারি। রোজা রাখতে পারি। কেননা পরকালে তিনিই হবেন আমাদের নাজাতের উছিলা। এই মিলাদুন্নবি পালন করা তখনই সার্থক হবে, যখন মানবজাতি তাঁর দেখানো পথে সঠিকভাবে চলতে পারবে। তাঁর প্রতিটি সুন্নত সুন্দরভাবে পালন করবে।

অপরদিকে আমরা যখন সিরাতুন্নবি বা রাসুলের জীবনী নিয়ে আলোচনা করতে যাব তখন আমরা আমাদের ব্যর্থতাকেই বেশি দেখতে পাবো। কেননা যেই সোনালি যুগ রাসুল সঃ আমাদের মাঝে রেখে গিয়েছিলেন, তাঁর কোনটায় আমরা ধরে রাখতে পারি নাই। যার কারণে সমাজ আজ আবার ধংসের মুখে। মুসলিম সমাজ আজ সবথেকে বেশি নিপিরিত। তাঁর পালন করা সুন্নতগুলো আজ আমাদের মাঝে নাই। আজকে আমরা আবার পথ হারা হয়ে গিয়েছি। যেই রাসুল আমাদেরকে সুন্দর জীবনের শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই শিক্ষা আজ আমাদের মাঝথেকে হারিয়ে গিয়েছে। যিনি এসেছিলেন মানবজাতির সুসংবাদ নিয়ে, মানব জাতির মুক্তি নিয়ে, সকল কিছু থেকে আজ মানুষ বিপথে চলে গিয়েছে। ওই দিক থেকে মানুষ আজ খুবই অসহায়। রাসুল সঃ যেই বাতিল বেবস্থাকে পরাজিত করে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন তাঁর ন্যায়পরায়নতা দিয়ে, সেই বাতিল বেবস্থাই আবার সত্যকে পরাজিত করার পায়তারা করছে।
রাসুলের দেখানো পথে যদি আমরা আবার ফিরে আসতে না পারি তাহলে খুব সহসাই আমাদের করুন পরিনতি বরন করে নিতে হবে।
রাসুল সঃ এর জন্ম মৃত্যু সকল কিছুই মানব জাতির জন্য একটি শিক্ষা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ''তিনি আল্লাহ, যিনি রাসুল সঃ কে হেদায়াত ও সত্য জীবন বিধানসহ পাঠিয়েছেন, যেন তিনি এই দ্বীনকে সমস্ত বাতিল বেবস্থা সমুহের উপর বিজয়ী করেন''। (আল কোরআন)
রাসুল সঃ কোন সাধারন মানুষ না তিনি একজন অসাধারণ মানুষ। তাঁর শ্রেষ্টত্ত এতটাই বিশাল যে, যার একটি প্রমান আমরা হাদিছে দেখতে পাই, রাসুল সঃ বলেন,
''যে বেক্তি সাক্ষ দিলেন যে,আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই,এবং হযরত মুহাম্মাদ সঃ আল্লাহর রাসুল। তাঁর জন্য আল্লাহ দোযখের আগুন হারাম করে দেবেন''।
 রাসুল সঃ ৬৩ বছরের জীবনীতে আমরা সবকিছুই খুজে পাব। তিনি নির্দিষ্ট কোন বিষয় বাস্তবায়নের জন্য আসেনি। তিনি এসেছেন পরিপূর্ণ একটি জীবন বেবস্থা নিয়ে। মুসলিম বিশ্বের এই ক্রান্তিলগ্নে রাসুলের দেখানো পথে ফিরে আসা খুবই জরুরি। সকল প্রকার ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে সকলকে শামিল হতে হবে। আল্লাহ আমাদের কে হেদায়াত দান করুক।