স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য

স্রষ্টা এবং সৃষ্টি, এই দুইটা বিষয় একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। সৃষ্টি যেহেতু আছে, স্রষ্টা থাকা আবশ্যক। আবার অন্যদিকে স্রষ্টা থাকলে সৃষ্টি থাকা প্রয়োজন। তাই সৃষ্টির সবসময় স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য করা অপরিহার্য একটি বিষয়। স্রষ্টা বিহীন কখনোই সৃষ্টি সম্ভব না। তেমনি সৃষ্টির জন্য স্রষ্টার প্রয়োজন। এই আকাশ,বাতাশ,নভমণ্ডলী পশুপাখি, মানুষ যা কিছু আছে সব কিছুই একটা সৃষ্টি। কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়া এক কথায় বলা যায় এই বিশ্ব জাহানে যা কিছু আছে সব কিছুর পেছনে একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন।
ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে রব বা আল্লাহ বলে থাকি। কোরআনের ভাষায় আমরা জানতে পারি যে, সকল সৃষ্টির মালিক মহান আল্লাহ তায়ালা। যারা ধর্ম মানেনা তাদের হিসাবটা আবার আলাদা।  সেই বিষয়ে আলোকপাতে নাইবা গেলাম।বিশ্বের প্রতিটি ধর্মে এক বাক্যে সবাই মানেন যে বিশ্ব জাহান সৃষ্টির পেছনে একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন।যার কারনে সবাই সবার মত করে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য করে যাচ্ছে।

মানব জাতির সবথেকে বড় পাওয়া হলো, সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে সকল সৃষ্টির মাঝে সেরা জীব হিসাবে মনোনীত করেছেন। কয়েক লাখ সৃষ্টির ভিতরে মানুষই একমাত্র জীব যাকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন। এইজন্য সমস্ত প্রসংশা ও শুকরিয়া আদায় করা সকল মানুষের জন্য অপরিহার্য। কেননা আমরা আমাদের বিবেক বুদ্ধিদ্বারা সকল কাজ সম্পাদন করতে পারি। আমাদের জাগতিক সকল চাহিদা পূরণে মেধাকে কাজে লাগিয়ে তা আদায় করে নিতে পারি। সৃষ্টিকর্তা মানব জাতিকে পৃথিবীর সকল সৃষ্টির মাঝে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে মানোনিত করেছেন। যেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য সবথেকে বড় অনুগ্রহ। তিনি যে আমাদের প্রতি কত দয়াবান, সেটা তাকে নিয়ে গবেষণা না করলে বুঝা কঠিন। সৃষ্টিকর্তার দয়া অনুগ্রহ না বুঝার কারণে মানুষ আজ গোমরাহির পথ বেছে নিয়েছে। এই গোমরাহির পথ থেকে সকলকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগেযুগে অসংখ্য নবী রাসুল এই দুনিয়ায়  প্রেরণ করেছেন। যার সঠিক হিসাব আজ আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। কেউ বলছে একলক্ষ কেউ বলছে দুইলক্ষ চব্বিশ হাজার। কিন্তু আমদের কোরআনে মাত্র ২৫ জন নবী রাসুলের নাম দেয়া আছে। সৃষ্টিকর্তা যে আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে চান, এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করানোর পাশাপাশি পরকালের স্থায়ী শান্তির নিবাস জান্নাতে রাখার যে চিন্তা করে রেখেছেন, তা আমরা তাঁর সৃষ্টির নমুনা দেখলেই বুঝতে পারি।
সৃষ্টির প্রথম মানব সন্তান হলেন, হযরত আদম (আঃ)। তাঁর থেকে সৃষ্টি করেছেন হযরত হাওয়া (আঃ)কে। তাদের দুইজনের মধ্যে থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অদ্যবদি পর্যন্ত মানব সন্তান সৃষ্টির ব্যবস্থা চলমান রেখেছেন। পৃথিবী থেকে অনেক প্রাণীই আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে যাদের অস্তিত্ত আমরা এখন আর পাচ্ছিনা। কিন্তু বিজ্ঞান অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব আজ গবেষণা করে খুঁজে বের করেছেন।
মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা অস্তিত্ব হারাবার নয়। কেয়ামত পর্যন্ত বা পৃথিবী ধ্বংসের দিন পর্যন্ত মানুষের পদাচারনা এই পৃথিবীতে চলমান থাকবে। এটাও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একটা অনেক বড় নেয়ামত মানুষের জন্য।
যারা ইসলাম ধর্ম নিয়ে অনেক নেতিবাচক গবেষণা করে, তারা কখনো কখনো বলে থাকেন যে, আল্লাহ শুধুমাত্র তাঁর বিধান মেনে চলা মানুষদের শান্তির পথ দেখান। যারা মানেন না তাদের কোন দায়ভার আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নেননা। এটা তাদের একটা ভুল ধারণা। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সৃষ্টির প্রথম মানুষকেই একজন রাসুল বা পথপ্রদর্শক হিসাবে মানোনিত করে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। হযরত আদম আঃ একদিকে যেমন তিনি প্রথম মানব সন্তান, অন্যদিকে তিনি প্রথম নবীও। এথেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রথম থেকেই চেয়েছেন মানবজাতি যেন পথহারা না হয়ে যায়। অসংখ্য নবী রাসুলকে আল্লাহ এই দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন মানুষকে হেদায়াতের বানী শুনানোর জন্য। কাউকে দিয়েছেন তাঁর পক্ষ থেকে আসমানি কিতাব। আবার কাউকে আদেশ দিয়েছেন পূর্বের কিতাবের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার।
পবিত্র কোরআনের সুরা নিসা আয়াত ৫৯ তে আল্লাহ বলেন,""হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসুলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্য থেকে যে নেতা বা উলিল আমর তাঁর আনুগত্য কর""। (আল কোরআন)
অন্য আয়াতে তিনি আবার বলছেন, ""যে বেক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে,আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশ হতে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়,এবং সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে। আর প্রকৃত অর্থে এটাই হচ্ছে বিরাট সফলতা""। (আল কোরআন) সুরা নিসা ১৩।
এথেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সবসময় চেয়েছেন মানুষ যাতে তাঁর হুকুম আহকাম মেনে চলে, তারা যেন সঠিক পথে চলে। সৃষ্টির প্রতিটি কোনায় কোনায় তিনি তাঁর নেয়ামত  ধারা পরিপূর্ণ করে রেখেছেন। যে যেখানেই আছে সে সেখান থেকেই তাঁর নেয়ামত গ্রহন করছেন।
নেয়ামতের নিদর্শন স্বরূপ আল্লাহ রাব্বুল আল্লামিন আমাদের এই সাড়ে তিনহাত শরীরটা দিয়েছেন। যা দিয়ে আমরা আমাদের সকল কাজ অনায়াসে করতে পারতেছি। এই শরীরটা যে আমাদের কত বড় নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে সেটা আমরা অসুস্থ হলে বুঝতে পারি। শরীরের সামান্য একটা অংশে কোন ধরনের সমস্যা হলে যেই পরিমাণ খরচ হয়, সেগুলোর একটা হিসাব বের করলেই বুঝা যাবে আমাদের শরীরে কতগুলো নেয়ামত আল্লাহ তাঁর বিধান মেনে চলার বিনিময় দিয়ে দিয়েছেন।
অফুরন্ত রিজিকের ব্যবস্থা আমাদেরকে করে দিয়েছেন। আমাদেরকে সামজিকভাবে বসবাসের সুযোগ দিয়েছেন,দিয়েছেন সামাজিক মর্যাদা।
সৃষ্টিকর্তার এই নেয়ামতের বিপরিতে সকল মানুষের জন্য অপরিহার্য বিষয় হলো, তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। আনুগত্যের বিষয়ে প্রথম যে জিনিষটি হলো, সেটি স্রষ্টার প্রতি ঈমান আনা।
ঈমান এমন একটি বিষয়, যেটা একজন মুসলমানের জীবনের প্রথম শর্তই হলো ঈমান আনা। এর অর্থ হলো বিশ্বাস স্থাপন করা। এই ঈমানের  আবার স্তম্ভ হলো ৬টি। এই ৬টি বিষয়ের উপর ঈমান আনলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জীবনের একটা পরিবর্তন চলে আসবে। যেগুলো হলো,
১/ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা।
২/রাসুলের প্রতি ঈমান আনা।
৩/ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনা।
৪/আসমানি কিতাব সমূহের প্রতি ঈমান আনা।
৫/ তাকদির বা ভাগ্যের ভালো মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখা।
৬/আখেরাত বা পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখা।
পবিত্র কোরআনের আয়াত দারা এটাই প্রমানিত, উপরের ৬ বিষয়ের প্রতি একজন মানুষ যদি পূর্ণ ঈমান আনে তাহলে স্রষ্টার প্রতি তাঁর প্রাথমিক আনুগত্য স্বীকার করা হয়ে যায়।

স্রষ্টার আনুগত্যের বিষয়ে পরের যে বিষয়টি সেটি হলো, আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখা। যাকে আরবি ভাষায় তাওয়াককুল বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহকে পূর্ণ অভিবাবক হিসাবে মনে করা। অভিবাবক তিনিই যিনি তাঁর অধিনস্ত লোকদের কল্যাণের কথা চিন্তা করে, এবং অকল্যাণ হতে বাঁচিয়ে রাখেন। তাঁর মানে এই নয় যে হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকব আর আল্লাহ আমাদের সব করে দিবে এই আশা করবো। আমাদের সবসময় আল্লাহ্‌র দেয়া সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে ফলাফল আশা করার নামই হচ্ছে আল্লাহর উপর ভরসা করা বা তাওয়াককুল করা। এই বিষয়ে আল্লাহ কোরআনে বলেন,
''আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বোত্তম কর্মকর্তা। (আল ইমরান ১৭৩)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলছেন, '' আপনি আল্লাহর উপর ভরসা করুন কাজের জন্য আল্লাহ নিজেই যথেষ্ট''। (আহযাব ৩)

আনুগত্যের আরেকটি বিষয় হলো, সর্বশেষ আসমানি কিতাব, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রতিটা বাণী মেনে চলা। এই কোরআন হলো একটি ঐশিগ্রন্থ। এটা এমন একটি কিতাব যার একটি ভুল আজ পর্যন্ত কেউ ধরতে পারে নাই। যখন এই কিতাব নাজিল হয় তখন অনেকে একে ভ্রান্ত কিতাব হিসাবে আখ্যা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারে নাই। আল্লাহ নিজেই তাদেরকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, এর মতো করে একটি ছোট বাণী পারলে অনুকরণ করে দেখাও। কিন্তু কেউ তা পারে নাই। মানব জাতির সকল সমস্যার সমাধান এই কিতাবে আল্লাহ অনেক সুন্দরভাবে দিয়ে দিয়েছেন। এই কোরআন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন।
 '' তারা কি দাবি করে যে কোরআন আপনার বানানো? আপনি বলুন, তোমরা যদি তোমাদের দাবিতে সত্যবাদি হও তাহলে এর একটি সুরা বানিয়ে নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যাতিত কারো সাহায্য প্রয়োজন হলে তাদের কাছে যেতে পার''। (ইউনুস ৩৮)  সৃষ্টিকর্তার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য কোরআনের আলোয় নিজেকে আলোকিত করা অপরিহার্য বিষয়।
স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য করা যেহেতু সকলের দায়িত্ব, তাই তাঁর জীবন বিধানের উপরও আমাদের জীবনকে মানিয়ে চলাও একটি কর্তব্য। ইসলাম আল্লাহর মানোনিত ধর্ম। ইসলাম ধর্মের হুকুম আহকাম মেনে চলাও সকলের উচিৎ। আমি মুসলমান কিন্তু ইসলামের হুকুম পালন করবনা তা কখনোই হবেনা। ইসলামী জীবন ব্যাবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট বিষয় রয়েছে, যেগুলো পালন করা একজন মুসলমানের আবশ্যকীয় বিষয়। ইসলামের খুঁটি বা ভিত্তি মোট হলো ৫টি। যথাঃ
১/ কালিমা( লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ)
২/নামাজ।
৩/রোযা।
৪/হজ্ব।
৫/যাকাত।
স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ রুপে আনুগত্য করে তাঁর জীবন বিধানকে মেনে চলে তাঁর নৈকট্য লাভ করতে হলে উপরের ৫টি বিষয়ের উপর সর্ব অবস্থায় নিজেকে সোপে দিতে হবে। সর্বোপরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন খুব সুন্দর করে আমাদের এই শরীরটাকে নেয়ামত স্বরূপ দিয়েছেন। যাতে করে আমরা আমাদের যাবতীয় কাজ করতে পারি। তাঁর জীবন বিধান মেনে চলতে পারি। আমরা যদি আমাদের শরীরের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব কত সুন্দর আমাদের এই শরীরটা। কোথাও কোন চুল পরিমান ভুল নেই। যেখানে যা প্রয়োজন সেখানে সেটাই রেখেছেন। পাশাপাশি খাদ্য গ্রহন করার জন্য অফুরন্ত নেয়ামত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন। পৃথিবীর সকল প্রাণীকে মানুষের বশ্যতা স্বীকার করানোর শক্তি দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তার কথা বলতে গেলে সাগরের সকল পানিকে কালি হিসাবে নিলেও তাঁর নেয়ামতের পূর্ণ হিসাব তুলে ধরা যাবেনা।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া বা তাঁর আনুগত্য করার সবথেকে সহজ মাধ্যম হলো রাসুলে সঃ  এর জীবন আদর্শকে মেনে চলা। এই ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, তোমাদের শিক্ষার জন্য, আল্লাহর রাসুলের মধ্যেই রয়েছে উত্তম চরিত্রগুণ। তাঁর আদর্শ ও চরিত্রগুণ গ্রহন করতে পারলেই তোমাদের মুক্তি অবধারিত। আল্লাহ আমাদেরকে সকল অবস্থায় তাঁর হুকুম আহকাম মেনে চলে তাঁর রাসুলের দেখানো পথে চলার তৌফিক দান করুক।