কদম তলীর পীরসাব হুজুর




আজ কয়েকদিন ধরেই মাহিনের মন খুব খারাপ, মন খারাপের কারণও কাউকে বলছেনা। সবে মাত্র উচ্চমাধ্যমিকে উঠেছে ছেলেটি। বাবা মায়ের সাথেও ঠিকমত কথা বলছেনা, ছোট একটা বোন আছে নিলু, তার সাথেও ভালো আচরণ করছেনা। নিলু এবছর জে এস সি পরিক্ষা দিবে। মাহিনের বাবা একজন মধ্যম শ্রেণীর সরকারি কর্মচারী এবং আধুনিক মনা একজন মানুষ। মা গৃহিণী এখনো সেকেলেই রয়ে গেছে। ২০১৯ এ এসে এখনো তিনি গলায় অনেকগুলি তাবিজ ঝুলিয়ে রেখেছে, ঘর ভর্তি তাবিজও লটকিয়ে রেখেছে, যেটা মাহিনের বাবার মটেও পছন্দ না।

এদিকে আবার মেয়ের পরিক্ষা সামনে, মেয়ের পরিক্ষা ভালো হবার জন্য কদমতলির পীরসাব হুজুর থেকে কলম পড়া ও পানি পড়া নিয়ে এসেছে। পীরসাহেব বলেছেন, পরিক্ষায় প্রশ্ন কমন না পরলেও নাকি কলম নিজে থেকে লেখা শুরু করবে। আর পরিক্ষার আগেরদিন হলে গিয়ে পানি ছিটিয়ে আসতে হবে। যেটা মহিরুন্নেসার জন্ন একটা কঠিন কাজ হয়ে গেছে। এই পানি পড়া আর কলম পড়ার জন্য হুজুরকে নাকি অনেক বড় অংকের হাদিয়া দিতে হয়েছে। অন্যদিকে এই বিষয়টা নিয়ে মাহিনের বাবার মেজাজ অনেক খারাপ হয়ে আছে। হুজুরকে দেয়ার জন্য এক মাসের অগ্রিম বেতন অফিস থেকে তুলে বউয়ের হাতে দিতে হয়েছে।
রহিম সাহেব অফিস করার কারণে ছেলে মেয়ের খোঁজখবর তেমন একটা নিতে পারেনা, বলে রাখা ভালো মাহিনের বাবার নাম জনাব, আব্দুর রহিম। ছেলের অন্যমনস্ক দিকটা বাবার নজরে না পরলেও মার নজরে ঠিকি পরেছে। মহিরুন্নেসা মাহিনকে ডেকে জিজ্ঞাস করছেন বাবা তোর কি হয়েছে?
কিছুনা মা। মিথ্যা বলিস কেন? আমি কয়েকদিন ধরে লক্ষ করছি তুই কিছু একটা লুকাচ্ছিস।
গতকাল দেখলাম তুই বাথরুমে শুয়ে শুয়ে টয়লেট করছিস। জামিলা খালা যাবার সময় বলে গেছে এমন করলে কাল থেকে তিনি আর কাজে আসবেনা। তোর টয়লেট পরিস্কার করার জন্য সে কাজ নেয়নাই। আরও অনেক কথা বলে গেছে। আবার বলেছে তুই নাকি বুয়াকে তোর রুমে ডেকেছিস?
আজ তোর বাবা আসুক, কথা বলব তোকে নিয়ে, কদম তলীর পীরসাবের কাছে তোকে নিয়ে যাব। পীর সাহেব তোকে দেখলেই বলে দিবে, তোর কি হয়েছে।

রহিম সাহেব রাতে খাবার সময় মাহিনকে খাবার টেবিলে ডাকছেন, বাবা সন্তানদের যতটুকু কথা হয় তা এই খাবার টেবিলেই হয়। খেতে বসে হটাত করে মাহিন চিৎকার করে বলে উঠছে, বাবা টাকা দাও বেলুন কিনব। রহিম সাহেব থতমত খেয়ে জিজ্ঞাস করলেন বেলুন দিয়ে কি করবি? মাহিনের উত্তরঃ তোমার বিয়ে, বাসর ঘর সাজাবো। বাবা রেগে গিয়ে বলছেন এক থাপ্পর দিয়ে ৩২টা দাত ফেলে দিব। মাহিন আবার বলল, বাবা আমার ২৮ দাত ৩২টা এখনো হয় নাই, তোমার থেকে ৪টা দাও।

ছেলের এই অবস্থা দেখে রহিম সাহেব রীতিমত অবাক। শান্ত গলায় মহিরুন্নেসাকে জিজ্ঞাস করলেন মাহিনের কি হয়েছে? মহিরুন্নেসা বললেন, গত কয়েকদিন ধরেই মাহিন এমন অস্বাভাবিক আচরন করছে। তোমাকে আজ বলতাম, ওকে নিয়ে কদমতলির পীরসাব হুজুরের কাছে  যাব। হুজুরের কাছে গেলেই ও সুস্থ হয়ে যাবে। একথা শুনে রহিম সাহেবের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো। কোথায় বলবে ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চল, তানা বলে পীরসাবের কাছে যাবার কথা বলছে।
মাহিনের বাবা ওর মাকে ধমক দিয়ে বললেন, কাল ওকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাব। তখন আবার মায়ের উল্টো ধমক, আমার ছেলে কি পাগল? রহিম সাহেব রেগেমেগে বললেন তোমার যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যাও। তবে মনে রেখ হুজুরের কাছে যাবার জন্য কোন টাকা আমি দিবনা।
 তোমার টাকার দরকার নাই, আমার ছেলেকে হুজুরের কাছে নেয়ার জন্য যথেষ্ট টাকা আমার কাছে আছে।

মহিরুন্নেসা পীরসাব হুজুরের খাদেমকে ফোন দিলেন সিরিয়াল নেয়ার জন্য। হুজুরের কাছে যেতে হলে আগে থেকে সিরিয়াল নিতে হয়। সিরিয়াল ছাড়া হুজুর কোন রুগি দেখেন না। ফোন দিতেই হুজুরের খাদেম বলে দিলেন আগামি ৫দিন হুজুরের কোন সিরিয়াল নেয়া হচ্ছেনা। মহিরুন্নেসা জিজ্ঞাস করলেন কেন? ওপর প্রান্ত দেখে খাদেম আমজাদ বললেন হুজুর সিদ্ধি লাভ করার জন্য সিলেট মাজারে গেছেন। এদিকে মাহিনের অবস্থাও দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। খাদেম আমজাদকে মহিরুন্নেসা বললেন, হুজুর যখনি আসবেন তার সিরিয়ালটা যেন আগে দেয়া হয়। আর যেন তাকে ফোনে জানিয়ে দেয়া হয়। এই পাঁচদিন ছেলেকে কিভাবে রাখবে সেটাই এখন ভেবে কুল পাচ্ছেনা মহিরুন্নেসা।
 এখন সমস্যা হচ্ছে প্রতি রাতে বাবা মায়ের মাঝখানে মাহিন ঘুমায়, কোন অবস্থায় তাকে পাশে শুয়ানো যায়না।  বাবার সাথে গল্প করে বাবাকে কিভাবে বিয়ে দিবে, কেমন মেয়ের সাথে বিয়ে দিবে, কি কি করবে বিয়েতে,এই সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে বাবা মার ঘুমের ১২টা বাজিয়ে দিচ্ছে।

হুজুরের খাদেম আমজাদ আজ সকালে ফোন দিয়েছে, আগামিকাল সকালে বাবা মা সহ রোগীকে নিয়ে যেতে বলেছে। যাবার সময় অবশ্যই গোসল করে পাক পবিত্র হয়ে যেতে বলেছেন।
সমস্যা এখন আরও বড় হয়ে গেল, কোন অবস্থায় রহিম সাহেবকে মানানো যাচ্ছেনা সেখানে যাবার জন্য। ছেলের এই অবস্থায় না যেয়েও উপায় নাই। মহিরুন্নেসা নাছোড়বান্দা স্বামীকে সে নিয়ে যাবেই। না গেলে সে আর কোন রান্নাবান্নাই করবেনা। যার কারণে আজ সারাদিন কোন রান্নাও হয় নাই। ছেলে মেয়েদেরকে বাহির থেকে খাবার এনে খাওয়ানো হয়েছে। কোন কুল কিনারা না পেয়ে রহিম সাহেব হুজুরের কাছে যাবার জন্য রাজি হলেন।

খুব সকালে ফজরের নামাজের পর মাহিনের পরিবার কদমতলির পীরসাবের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকার কারণে সময়মত তারা পৌছাতে পারলেন না। খাদেম আমজাদ তাদেরকে এসে বললেন আজ আর কোন রুগি হুজুর দেখবেননা, কারণ সময়মত না আসতে পারলে হুজুর রুগি দেখেন না।
 আগামিকাল সকালে আবার আপনাদের ডাকা হবে, আজ বাড়ি চলে যান।
 এই কথা শুনে রহিম সাহেব আগুনে বেগুনে জলে উঠলেন, এতদুর থেকে আসলাম এখন বলছেন রুগি দেখবেননা। এটা কেমন কথা রুগির অবস্থাত আরও অনেক খারাপ হয়ে যেতে পারে। আমজাদ সুন্দরভাবে উত্তর দিলেন কোন সমস্যা নাই, হুজুরের কাছে আসছেন সব ঠিক হয়ে যাবে। হুজুর পারে না এমন কিছুই নাই। মরা মানুষ ও হুজুরের কাছে জিন্দা হইয়া যায়। আর আপনার ছেলেত সুধু পাগল; এটা হুজুরের এক হাতের খেইল। আমজাদ আরও বললেন বাড়িতে যাইতে না চাইলে এখানে থাকবার পারবেন, আমাদের এখানে থাকার বেবস্থা আছে। তবে খাওয়ার জন্য আলাদা টাকা দেয়া লাগব। প্রতি বেলা একশত টাকা, এখানে আবার খাবারের মেন্যুও আছে। সকালে রুটি ভাজি, দুপুরে সবজি ডাল ভাত,
রাতে মুরগি ডাল ভাত, পানি ফ্রি।

কোন উপায় না দেখে রহিম সাহেব পরিবার নিয়ে আজকের রাত এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। একটি রুমের দিকে সবাইকে নিয়ে রহিম সাহেব রওনা দিলেন থাকার জন্য, পেছন থেকে খাদেম আমজাদের বড় করে ডাক; খারান খারান কই যান? জামাই বউ একসাথে এখানে থাকা যায়না, পবিত্র জায়গা, একসাথে থেকে কখন কি না কি করে অপবিত্র বানাই ফেলেন, তাই জামাই বউ একসাথে থাকা নিষেধ। আসেন আমার সাথে আপনাকে আপনার থাকার জায়গা দেখাই দিচ্ছি, বলে রহিম সাহেবকে সাথে করে অন্য রুমের দিকে রওনা হলেন খাদেম আমজাদ। রহিম সাহেব কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না।

পরেরদিন সকালে মাহিনের চিকিৎসা শুরু হচ্ছে। মাহিনের সামনে লাল পাগরি পড়ে সাদা কাপর পড়া বিখ্যাত কদমতলির পীরসাব। চারদিক দিয়ে আগরবাতি জলছে। কেমন জানি একটা গন্ধ সাড়া ঘরে বিরাজ করছে। একটু পরপর খাদেম আমজাদ হক মাউলা বলে চিৎকার করে উঠছেন। বিষয়টা মটেও রহিম সাহেবের ভালো লাগছেনা। হুজুর মাহিন কে জিজ্ঞাস করছেন, বল তুই কথা থেকে এসেছিস? কেন এসেছিস? মাহিন চিৎকার করে বলে উঠলো হুজুর আপনার বিয়া দিতে আসছি। আসেন আপনাকে হলুদ লাগায় দেই, বলেই হুজুরের গালে মাহিন হাত বুলানো শুরু করছে। হুজুর খেপে গিয়ে বলছে এত দেখছি বড় জীন, ওকে বেন্দে ফেল।
 বেন্দে ফেলার কথা বলার সাথে সাথেই আমজাদ দৌড় দিয়ে গিয়ে দরি এনে মাহিন কে বেন্দে ফেললো। রহিম সাহেব রেগে গিয়ে ছেলেকে ছুটাতে গেলো হুজুর তাকে ধমক দিলেন। তার স্ত্রিও তাকে ধমক দিলেন। বললেন হুজুর যা করছে আমাদের ছেলের ভালোর জন্যই করছে, তুমি চুপ করে বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ কর।
 কোন কথা না বলে নিরব দর্শকের মত ছেলের অসহায়ত্ত দেখতে থাকলেন।

অন্ধকার ঘরের ভিতর কোনায় কোনায় মোমবাতির আলো জ্বলছে। মোমবাতির ঝাপসা আলোয় তেমন কিছুই বুজা যাচ্ছেনা, যতটুকু বুজা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে হুজুর কিছু একটা পড়ে একটু পরপর মাহিনের শরীরে ঝাড়ুর মত কিছু একটা দিয়ে বারি দিচ্ছে।
কিছুক্ষন পর হুজুরের খাদেম আমজাদ এসে মহিরুন্নেসাকে বললেন, আপনার ছেলের চিকিৎসা শেষ, আজকে নিয়া যাইতে পারবেন। তবে হুজুর কিছু আমল দিছে সেগুলা ঠিকমত পালন করতে হইব। তা না হলে সে পুরাপুরি ভালো হইতে পারবোনা।
 অনেক আগ্রহ নিয়ে মহিরুন্নেসা আমজাদকে জিজ্ঞাস করলো হুজুর কি আমল দিছে? হুজুর বলছে টানা পনেরো দিন সকালবেলা খোলা পুকুরে গোসল করে হুজুরের পানি পড়া খাইতে হইব। মহিরুন্নেসা খুব খুশি মনে হুজুরের হাদিয়া দিয়ে মাহিন কে আনতে গেলেন।

মাহিন অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে। কোন সাড়া শব্দ নাই। রহিম সাহেব আস্তে করে ছেলেকে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসালেন। ওদিকে মেয়ের পরিক্ষা। গত দুইদিন ধরে বাসায় মেয়েটা একা, কিভাবে কি করছে , কি খাচ্ছে, এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে গাড়ি বাসার সামনে চলে আসছে খেয়ালি করা হয়নাই।
বাসায় কলিংবেল বাজাতেই নিলু দরজা খুলল। দরজা খুলে প্রিয় ভাইয়ের এই অবস্থা থেকে পুরো অবাক। মাহিন কথা বলে না কেন মা?
তোমার ভাই অসুস্থত তাই একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, মায়ের স্বাভাবিক উত্তর।

আজ পাঁচদিন চলছে মাহিনের পীরসাবের দেয়া চিকিৎসা। কোন উন্নতি তো হচ্ছেইনা আরও বেড়েই চলছে মাহিনের পাগলামি। এদিকে ছেলের এই অবস্থার কোন উন্নতি না দেখে মহিরুন্নেসাও কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে।
রহিম সাহেব আর বউয়ের কথার তোয়াক্কা না করে ছেলেকে নিয়ে সাইক্রিয়াট্রিষ্টের কাছে নিয়ে গেলেন।
ডাক্তার সবকিছু দেখে বললেন, রহিম সাহেব কিছু মনে করবেননা আপনার ছেলে পুরো পাগল হয়ে গিয়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা লাগবে। আপনারা অনেক দেরি করে ফেলেছেন।
রহিম সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।

আজ প্রায় পাঁচ মাস হতে চলেছে, মহিরুন্নেসা এখনো প্রতিদিন সকালে পুকুরে গোসল করে মাহিনের ঘরে পীরসাবের দেয়া পানি ছিটিয়ে আসে।